Sunday, 8 December 2019

বিশ্ব উষ্ণায়ন রচনা

ভূমিকা:

বর্তমানে প্রগতির ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে উন্নয়নের রঙিন চশমা পড়েছে মানুষ। কিন্তু লাগামছাড়া উন্নয়ন আঁধার নামিয়ে আনছে, তা জেনেও বুঝতে চাইছে না মানুষ। তাই ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর একটা গালভরা নাম আছে, বিশ্ব ঊষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং।
বিশ্ব উষ্ণায়ন কি ও কিভাবে হয়?  
চারিদিকে যে বিশ্ব উষ্ণায়নের চাপে জেরবার মানুষ, তা আসলে কি? গ্রিণ হাউস গ্যাসের প্রভাব, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অরণ্যচ্ছেদন প্রভৃতি কারণে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, একেই গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন বলে।
গ্রিন হাউস গ্যাসগুলি হল- কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্যাস। এ গ্যাস পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমন্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি ধ্বংস করার ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ প্রচুর বেড়ে গেছে। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমন্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাগ্রস্থ হয় এবং এভাবেই বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধি।

পরিসংখ্যান:

বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন,  গত ১০০ বছরের অনুপাতে প্রমাণিত যে এই তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে বিগত প্রায় ৮০০০ বছর ধরে তাপমাত্রা প্রায় স্থির ছিল। বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, বিগত ১০০ বৎসরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আগামী তিরিশ বছরের মধ্যে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৫ডিগ্রী থেকে ২.০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হবে। ২১০০ সালের মধ্যে ১.৮ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৬.৩ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মতো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান।

বিশ্ব উষ্ণায়ন-এর কারণ:

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ মানুষ। হ্যাঁ আমরাই সভ্যতাকে ক্রমশ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। শিল্প, নগরায়ন, প্রগতির পথে এগিয়ে লাগামছাড়া উন্নয়নের প্রচেষ্টায় নিজের ক্ষতি নিজেরাই ডেকে আনছি আমরা। যেসব কাজের ফলে গ্রিণ হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি ও ওজোন স্তরের ক্ষতি হচ্ছে, সেগুলি হল-
ক) কলকারখানা, যানবাহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সবকিছুতেই জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। খ) কলকারখানা-যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, ট্যানারির বর্জ্য পদার্থ, জেট বিমান, রকেট উৎক্ষেপণ– এইসব থেকে নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফারের কণা উৎপাদন হয়, যা ক্ষতিকারক। গ) এয়ার কন্ডিশনার, ফোম শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ওজোন স্তরের ক্ষতির অন্যতম কারণ। ঘ) গাছপালার পচন, কৃষিজ বর্জ্য এবং জীব জন্তুদের বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের পেছনে সবথেকে বড় কারন অরণ্যচ্ছেদন। গাছপালা কেটে ফেলার জন্য বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

প্রভাব:

উপরে আলোচিত কারণগুলির ফলে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।
বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই উষ্ণায়নের ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ি, গত ২০০০০ বছরের তুলনায় শেষ শতকে বিশ্বের উষ্ণতা সবথেকে বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে।
গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, আরও ১০০বছরের মধ্যে সুমেরু-কুমেরুতে গরমকালে সমস্ত বরফ জলে পরিণত হবে। ১৯৭০এর পর উত্তর মহাসাগরের বরফের স্তর প্রায় ২৭% হ্রাস পেয়েছে।
এই ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার ফলে বিষুবীয় ও মেরু অঞ্চলের জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলস্তর ৩০–৪০সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। এরফলে পৃথিবীর উপকূলবর্তী এলাকার একটি বিরাট অংশ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
জলস্তর বাড়লে মশা বাড়বে। ম্যালেরিয়া, গোদ, কলেরা ডেঙ্গু প্রভৃতি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আরো ভিন্ন রোগ ফিরে আসবে, নতুন রোগ হবে।
এছাড়াও জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটবে, ফসলের ক্ষতি, প্রাকৃতিকভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, বন্যজন্তুও কমে যাবে, পানীয় জলে সংক্রমণ দেখা দেবে, মানুষের বাসস্থান সংকট দেখা দেবে, খাদ্যভাব প্রবলভাবে বৃদ্ধি হবে, কোথাও ক্ষরা, আবার কোথাও বন্যার প্রকোপ দেখা দেবে, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, খাদ্যদাঙ্গা শুরু হবে। পৃথিবীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা একসাথে বৃদ্ধি পাবে। সভ্যতা ধ্বংসের মুখে অগ্রসর হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রণ:

মানব সভ্যতা ধ্বংসের মুখে প্রায়। এই নিয়ে পরিবেশবিদ্‌ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র সবদিক থেকে চাপ বাড়ছে সমস্যার সমাধানের জন্য। ট্রাইবুনাল, গ্রিণ বেঞ্চ ইত্যাদি গঠন হয়েছে। কিছু আশু সমাধানও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যেমন::
 কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস করতে হবে।
 কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে হবে।
 মিথেন গ্যাস নির্গমনের উৎসগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
 জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমিয়ে অপ্রচলিত শক্তির প্রচলন করতে হবে।
 গাছ-ই আমাদের টিকে থাকার অন্যতম উপায়। অরণ্য গড়ে তোলার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে। শক্তিসাশ্রয়ী আবাসন গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়াও পরিবেশ রক্ষা চুক্তিগুলির বাস্তব রূপায়ণ প্রয়োজন। বিকল্প ও পরিবেশবান্ধব দ্রব্য ব্যবহার।

উপসংহার:

পরিবেশ রক্ষা আমাদের কর্তব্য। আমাদের বেঁচে থাকার আধারকে টিকিয়ে রাখলেই আমরা টিকে থাকবো।  তাই যেসকল ক্ষতিকারক উপাদানের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন হচ্ছে, সেগুলি যাতে কম উৎপাদিত হয়, সে বিষয়ে পরিচালনা করার দায়িত্ব মানুষের। সবশেষে সুকুমার রায়ের বক্তব্য দিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই–
“তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।”

No comments:

Post a Comment