► লেন্স [Lens]:- দুটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক তল দ্বারা বেষ্টিত সমসত্ব এবং স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যমের অংশ বিশেষকে লেন্স বলে । তল দুটির উভয়েই গোলীয় [spherical] বা একটি গোলীয় এবং অপরটি সমতল হতে পারে ।
লেন্স দুই প্রকারের আছে ; যথা: [১] উত্তল লেন্স বা অভিসারী লেন্স এবং [২] অবতল লেন্স বা অপসারি লেন্স ।
[১] উত্তল লেন্স [Convex lens] বা অভিসারী লেন্স [Converging lens]:- যে লেন্সের মধ্যস্থল মোটা এবং প্রান্তের দিকটা অপেক্ষাকৃত সরু তাকে উত্তল বা অভিসারী লেন্স বলে ।
[২] অবতল লেন্স [Concave lens] বা অপসারি লেন্স [Diverging lens] :- যে লেন্সের মধ্যস্থল সরু এবং প্রান্তের দিকটা মোটা তাকে অবতল বা অপসারি লেন্স বলে ।
► বিভিন্ন প্রকারের লেন্স [Different Types of Lenses]:- লেন্সের দুই তলের আকারের ওপর নির্ভর করে উত্তল এবং অবতল লেন্সের প্রত্যেককে আবার তিনটি শ্রেণিতে (মোট ছয়টি) ভাগ করা যায় ।
[1] উভোত্তল [Double Convex]:- যে লেন্সের দুটি তলই উত্তল তাকে উভোত্তল লেন্স বলে । এই লেন্সের দুই পৃষ্ঠের বক্রতা ব্যাসার্ধ সমান হলে তাকে সমোত্তল লেন্স [Equiconvex lens] বলে ।
[2] সমতলোত্তল [Plano Convex]:- যে লেন্সের একটি তল সমতল এবং অপর তলটি উত্তল তাকে সমতলোত্তল লেন্স বলে ।
[3] অবতলোত্তল [Concavo Convex]:- যে লেন্সের একটি তল অবতল এবং অপর তলটি উত্তল তাকে অবতলোত্তল লেন্স বলে । এই লেন্সের অবতল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ উত্তল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধের চেয়ে বেশি হয় ।
[4] উভাবতল [Double Concave]:- যে লেন্সের দুটি তলই অবতল হয় তাকে উভাবতল লেন্স বলে । এই লেন্সের দুই পৃষ্ঠের বক্রতা ব্যাসার্ধ সমান হলে তাকে সমাবতল লেন্স [Equiconcave lens] বলে ।
[5] সমতলাবতল [Plano Concave]:- যে লেন্সের একটি তল সমতল এবং অপর তলটি অবতল হয় তাকে সমতলাবতল লেন্স বলে ।
[6] উত্তলাবতল [Convexo Concave]:- যে লেন্সের একটি তল উত্তল এবং অপর তলটি অবতল তাকে উত্তলাবতল লেন্স বলে । এই লেন্সের উত্তল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধের চেয়ে অবতল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ কম হয় ।
► লেন্স কর্তৃক আলোর প্রতিসরণ এবং ফোকাসিং ক্রিয়া [Refraction of light by lens and focusing action]:-
একটি উত্তল কিংবা অবতল লেন্সকে কয়েকটি ছোটো ছোটো খন্ডিত প্রিজমের সমষ্টি বলে মনে করা যেতে পারে । উত্তল লেন্সের ক্ষেত্রে এই প্রিজমগুলির ভূমি লেন্সের কেন্দ্রের দিকে অভিমুখী এবং লেন্সের কেন্দ্র থেকে যে প্রিজমটি যত দূরবর্তী তার প্রতিসারক কোণ তত বেশি । আবার আলোকরশ্মি কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে গেলে ভূমির দিকে বেঁকে যায় এবং যে প্রিজমের প্রতিসারক কোণ যত বেশি তার ক্ষেত্রে আপতিত রশ্মির চ্যুতিও তত বেশি । তাই উত্তল লেন্সের ভিতর দিয়ে প্রতিসৃত হলে সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ অভিসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত হয় এবং একটি বিন্দুতে মিলিত হয় ।একেই লেন্সের ফোকাসিং ক্রিয়া বলে । এজন্য উত্তল লেন্সকে অভিসারী লেন্স বলা হয় ।
এইভাবে অবতল লেন্সে প্রিজমগুলির ভূমি লেন্সের কেন্দ্র থেকে বিপরীত দিকে থাকে । এক্ষেত্রে রাশ্মিগুলির চ্যুতি বিপরীত হবে । ফলে সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ লেন্স কর্তৃক প্রতিসৃত হওয়ার পর মনে হবে যেন একটি বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে অর্থাৎ, সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ অপসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত হবে । এজন্য অবতল লেন্সকে অপসারী লেন্স বলা হয় ।
• দ্রষ্টব্য : লেন্সের চারপাশের মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক লেন্সের উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক অপেক্ষা বেশি হলে, উত্তল ও অবতল লেন্সের ওপরে বর্ণিত ক্রিয়া উল্টে যাবে— অর্থাৎ উত্তল লেন্স অপসারী এবং অবতল লেন্স অভিসারী হবে । সুতরাং উত্তল লেন্স মাত্রই অভিসারী আর অবতল লেন্স মাত্রই অপসারী হবে— একথা ঠিক নয় । লেন্সের অপসারী ও অভিসারী হওয়ার ক্ষমতা লেন্সের পারিপার্শ্বিক মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে ।
► কয়েকটি সংজ্ঞা [Some Definitions]:-
[i] বক্রতা কেন্দ্র [Centre of curvature]:- লেন্সের উভয় তলই যদি গোলীয় হয় তবে এরা প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট গোলকের অংশ হবে ।ওই গোলকের কেন্দ্রকে ওই তলের বক্রতা কেন্দ্র বলে ।
[ii] বক্রতা ব্যাসার্ধ [Radius of of curvature]:- লেন্সের কোনো তল যে গোলকের অংশ হবে ওই গোলকের ব্যাসার্ধকে ওই তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ বলে ।
[iii] প্রধান অক্ষ [Principal axis]:- যদি লেন্সের দুই তল গোলীয় হয় তবে ওই তলদুটির বক্রতা কেন্দ্র দুটিকে যোগ করলে যে সরলরেখা পাওয়া যায় তাকে ওই লেন্সের প্রধান অক্ষ বলে ।
[iv] পাতলা লেন্স [Thin lens]:- লেন্সের বেধ যদি ওর পৃষ্ঠতল দুটির বক্রতা ব্যাসার্ধের তুলনায় খুব ছোটো হয়, তাহলে ওই লেন্সকে পাতলা লেন্স বলে ।
[v] উন্মেষ [Aperture]:- লেন্সের ব্যাসকে লেন্সটির উন্মেষ বলে ।
[vi] আলোককেন্দ্র [Optical Centre]:- যদি কোনো আলোক-রশ্মি লেন্সের কোনো তলে এরূপভাবে আপতিত হয় যে, লেন্সের ভিতর দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে দ্বিতীয় তল থেকে নির্গত হওয়ায় সময় এটি আপতিত রশ্মির সমান্তরালভাবে নির্গত হয়, তবে লেন্সের ভিতরে প্রতিসৃত রশ্মির গতিপথ প্রধান অক্ষকে যে বিন্দুতে ছেদ করে সেই বিন্দুকে লেন্সের আলোককেন্দ্র বলে । পাতলা লেন্সের ক্ষেত্রে আলোককেন্দ্র দিয়ে কোনো আলোক-রশ্মি গেলে, রশ্মির কোনো চ্যুতি বা পার্শ্ব-সরণ হয় না— আপতিত রশ্মি সোজাপাথে লেন্স থেকে নির্গত হয়ে যায় ।
◘ প্রমাণ করা যায় যে— অবতলোত্তল এবং উত্তলাবতল লেন্সে আলোককেন্দ্র অপেক্ষাকৃত কম বক্রতা ব্যাসার্ধের তলের দিকে লেন্সের বাইরে প্রধান অক্ষের উপর অবস্থান করে ।
[vii] মুখ্য ফোকাস ও ফোকাস দুরত্ব [Principal focus and focal length]:- যদি কোনো সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরালভাবে এসে লেন্সের ওপর পড়ে, তাহলে প্রতিসরণের পর রশ্মিগুচ্ছ উত্তল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর অবস্থিত একটি বিন্দুতে মিলিত হয়; কিংবা অবতল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর অবস্থিত কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় । সেই বিন্দুটিকে লেন্সের মুখ্য ফোকাস বলে । লেন্সের আলোককেন্দ্র থেকে মুখ্য ফোকাসের দূরত্বকে ফোকাস(ƒ) দূরত্ব বলা হয় ।
◘ লেন্সের দুটি মুখ্য ফোকাস আছে । ওই দুটি ফোকাস আলোক কেন্দ্রের বিপরীত দিকে এবং লেন্সের উভয় দিকের মাধ্যম একই রকম হলে, আলোক কেন্দ্র থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় ফোকাস সমান দূরত্বে থাকে ।
[viii] ফোকাস তল [Focal plane]:- মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থিত তলকে লেন্সের ফোকাস তল বলে ।
[ix] গৌণ ফোকাস [Secondary focus]:- যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল রশ্মি লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সামান্য কোণ করে লেন্সে আপতিত হয়, তাহলে প্রতিসরণের পর রশ্মিগুচ্ছ উত্তল লেন্সের ফোকাস তলে মিলিত হয়, কিংবা অবতল লেন্সের ফোকাস তলের কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় । এই বিন্দুকে লেন্সের গৌণ ফোকাস বলে ।
► উত্তল লেন্স দ্বারা সৃষ্ট সদ্ ও অসদ প্রতিবিম্ব গঠন [Formation of real and virtual images by a convex lens]:-
উত্তল লেন্সের সাহায্যে বস্তুর যে প্রতিবিম্ব গঠিত হয়, তা লেন্সের চারটি ধর্মের ওপর নির্ভর করে ।
(i) যে আলোক-রশ্মি লেন্সের আলোক কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে যায়, প্রতিসরণের পর তার অভিমুখের কোনো পরিবর্তন হয় না ।
(ii) বস্তু থেকে নির্গত আলোক-রশ্মি, প্রধান অক্ষের সমান্তরাল হয়ে উত্তল লেন্সে আপতিত হলে প্রতিসরণের পর মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে যাবে ।
(iii) উত্তল লেন্সের মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে আগত কোনো আলোক-রশ্মি লেন্সে প্রতিসৃত হলে প্রধান অক্ষের সমান্তরাল হয়ে নির্গত হবে ।
(iv) কোনো বস্তু লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থান করলে ওর প্রতিবিম্বটিও প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে গঠিত হবে ।
(i) বস্তুর চেয়ে খুব ক্ষুদ্র সদবিম্ব :
(ii) বস্তুর চেয়ে বড়ো সদবিম্ব :
(iii) বস্তুর চেয়ে বড়ো অসদবিম্ব :
► রৈখিক বিবর্ধন [Linear magnification]:- লেন্স দ্বারা লক্ষবস্তুর যে প্রতিবিম্ব গঠিত হয় তা লক্ষবস্তুর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে বস্তু অপেক্ষা বড়ো বা ছোটো বা সমান হতে পারে অর্থাৎ লেন্সের বিবর্তন ক্ষমতা [magnifying power] আছে । রৈখিক বিবর্ধন বলতে প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য ও লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্যের অনুপাত বুঝায় ।
রৈখিক বিবর্ধন (m) = প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য / লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্য
প্রমাণ করা যায় যে লেন্সের আলোককেন্দ্র থেকে বস্তু দূরত্ব = u এবং প্রতিবিম্ব দূরত্ব = v হলে, যে-কোনো লেন্সের ক্ষেত্রে রৈখিক বিবর্ধন m = প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য / লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্য =v/u ।
► বিবর্ধক কাচরূপে উত্তল লেন্স [Convex lens as a magnifying glass]:-
লক্ষবস্তু যদি উত্তল লেন্সের ফোকাস দূরত্বের মধ্যে থাকে, তাহলে লেন্স দ্বারা গঠিত প্রতিবিম্ব অসদ, এবং বস্তুর চেয়ে আকারে বড়ো এবং সোজা হয় । উত্তল লেন্সকে বিবর্ধক কাচ হিসাবে ব্যবহার করা হয় । কোনো বই -এর পাতার খুব কাছে উত্তল লেন্স ধরে ওপর থেকে দেখলে অক্ষরগুলিকে বড়ো বড়ো দেখায় । লেন্সের ফোকাস দৈর্ঘ্য যত কম হয়, প্রতিবিম্বের বিবর্ধনও তত বেশি হয় । তাই খুব কম ফোকাস দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট উত্তল লেন্সকে বিবর্ধক কাচ হিসাবে ব্যবহার করা হয় ।
• লেন্স চিনবার সহজ উপায় :- লেন্সের খুব কাছে একটি আঙ্গুল রেখে অপর পাশ থেকে দেখলে যদি আঙ্গুলটির প্রতিবিম্ব আকারে বড়ো এবং সোজা হয় তবে লেন্সটি হবে উত্তল, আর যদি প্রতিবিম্ব আকারে ছোটো এবং সোজা হয় তবে লেন্সটি হবে অবতল ।
► আলোর বিচ্ছুরণ [Dispersion of light]:-
• সংজ্ঞা:- সাদা কিংবা কোনো বহুবর্ণী রশ্মিগুচ্ছের বিভিন্ন বর্ণে বিভাজিত হওয়ার ঘটনাকে আলোর বিচ্ছুরণ বলে । স্যার আইজ্যাক নিউটন আলোর বিচ্ছুরণ আবিষ্কার করেন । তিনি দেখতে পান যে, সূর্য রশ্মি (সাদা আলো) কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে গেলে সাতটি বিভিন্ন বর্ণের রশ্মিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।
[i] প্রিজম:- তিনটি আয়তাকার এবং দুটি ত্রিভুজাকার তল দ্বারা সীমাবদ্ধ সমসত্ব ও স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যমকে প্রিজম বলে ।
[ii] প্রতিসারক তল:- আলোক রশ্মি প্রিজমের যে তলে আপতিত হয় এবং তল থেকে নির্গত হয় তাদের প্রতিসারক তল বলে ।
[iii] প্রান্তরেখা:- পাশাপাশি দুটি প্রতিসারক তল পরস্পর যে রেখায় মিলিত হয়, তাকে প্রান্তরেখা বলে ।
[iv] প্রধান ছেদ:- প্রিজমের প্রতিসারক তলকে লম্বভাবে ছেদ করলে যে তল পাওয়া যায়, তাকে প্রিজমের প্রধান ছেদ বলে ।
[v] প্রতিসারক কোণ :- দুটি প্রতিসারক তল পরস্পর যে কোণে মিলিত হয়, ওই কোণকে প্রতিসারক কোণ বলে ।
[vi] ভূমি:- প্রতিসারক কোণের বিপরীত তলকে প্রিজমের ভূমি বলে ।
► সাদা আলোর বিচ্ছুরণ [Dispersion of white light]:-
• পরীক্ষা:- একটি অস্বচ্ছ পর্দার একটি সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে সাদা আলোক রশ্মি একটি প্রিজমের প্রতিসারক তল এর ওপর আপতিত হল । প্রিজমের অপর প্রতিসারক তল থেকে নির্গত হয়ে আলোক রশ্মি যখন একটি পর্দা -এর উপর পড়বে তখন পর্দায় সাতটি বিভিন্ন বর্ণবিশিষ্ট একটি পটি দেখতে পাওয়া যাবে । এই পটির একেবারে ওপরে লাল [Red], তারপর যথাক্রমে কমলা [Orange], হলুদ [Yellow], সবুজ [Green], আকাশি নীল [Blue], গাঢ় নীল [Indigo] এবং সবচেয়ে নীচে বেগুনি [Violet] থাকে । এই বহুবর্ণবিশিষ্ট পটিকে বর্ণালী বলে । প্রিজম আলোর বর্ণ সৃষ্টি করে না— সাদা বা বহুবর্ণী আলোর মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন বর্ণের আলোক রশ্মিগুলিকে পৃথক করে মাত্র ।
♦ শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না কেন ?
শূন্য মাধ্যমে সব বর্ণের আলো সমান বেগে চলার ফলে আলোকরশ্মির কোনো প্রকার চ্যুতি ঘটে না । তাই শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না ।
• রামধনু [Rainbow]:- রামধনু হল আলোক বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ । যদি বায়ুমণ্ডল সদ্য বৃষ্টিস্নাত হয়, তবে কখনো কখনো সূর্যের বিপরীত দিকের আকাশে ধনুকের মতো বাঁকা বিভিন্ন রং -এর পটি দেখা যায়— একেই রামধনু বলে । বৃষ্টির কণা দ্বারা সুর্যরশ্মির বিচ্ছুরণের ফলে এই ঘটনা ঘটে ।
☼ বর্ণালি [Spectrum]:-
• সংজ্ঞা:- সাদা আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রতিসরণের ফলে বিশ্লিষ্ট হয়ে সাতটি বিভিন্ন বর্ণের আলোকগুচ্ছে পরিণত হয় । প্রিজম থেকে নির্গত এই আলোকগুচ্ছকে পর্দায় ফেললে, পর্দায় ওই সাতটি বিভিন্ন বর্ণের আলোক দ্বারা তৈরি চওড়া যে পটি পাওয়া যায়, তাকে বর্ণালি বলে ।
সাদা আলোর বিচ্ছুরণে প্রাপ্ত বর্ণালির মধ্যে যে সাতটি বর্ণ থাকে, সেই বর্ণগুলির ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষরগুলিকে, বর্ণালিতে পাওয়া সাতটি বর্ণের ক্রম অনুযায়ী সাজালে 'VIBGYOR' শব্দটি পাওয়া যায় । অনুরূপ ভাবে বাংলা নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে সাজালে (বেগুনি, নীল, আকাশি নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, এবং লাল) 'বেনীআসহকলা' শব্দটি পাওয়া যায় ।
☼ শুদ্ধ বর্ণালি [Pure Spectrum]:- যে বর্ণালিতে সাদা আলোর সাতটি বর্ণ পৃথক ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় এবং বর্ণগুলি নিজ নিজ স্থান দখল করে থাকে, তাকে শুদ্ধ বর্ণালি বলে ।
☼ অশুদ্ধ বর্ণালি [Impure Spectrum]:- যে বর্ণালিতে সাদা আলোর সাতটি বর্ণ একে অন্যের ওপর পড়ার ফলে বিভিন্ন বর্ণ পৃথক ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না এবং বর্ণগুলি নিজ নিজ স্থান দখল করে থাকে না, তাকে অশুদ্ধ বর্ণালি বলে ।
প্রশ্ন:- সাদা আলোর বিশুদ্ধ বর্ণালির প্রান্তিক বর্ণ দুটি কী কী ?
উত্তর:- সাদা আলোর বিশুদ্ধ বর্ণালির প্রান্তিক বর্ণ দুটি হল লাল ও বেগুনি ।
প্রশ্ন:- শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না কেন ?
উত্তর:- শূন্য মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সমতুল কোনো কণা না থাকায় ওই মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না ।
প্রশ্ন:- আলোকের বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ দাও ।
উত্তর:- আলোকের বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ হল রামধনু ।
প্রশ্ন:- বস্তুর কোন অবস্থানে উত্তল লেন্স দ্বারা সদ্ প্রতিবিম্ব গঠিত হয় ?
উত্তর:- উত্তল লেন্স থেকে কোনো বস্তুর দুরত্ব লেন্সটির ফোকাস দৈর্ঘ্যের সমান বা ফোকাস দৈর্ঘ্য থেকে বেশি হলে বস্তুটির সদ্ প্রতিবিম্ব গঠিত হয় ।
প্রশ্ন:- বিবর্ধক কাচে কী ধরনের লেন্স ব্যবহার করা হয় ?
উত্তর:- বিবর্ধক কাচে উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হয় ।
প্রশ্ন:- বিবর্ধক কাচের দুটি ব্যবহার উল্লেখ করো ।
উত্তর:- বইয়ের ছোটো অক্ষর এবং ঘড়ির সূক্ষ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দেখার জন্য বিবর্ধক কাচ ব্যবহার করা হয় ।
প্রশ্ন:- কোন বর্ণকে মধ্য বর্ণ বলে ?
উত্তর:- বর্ণালি থেকে বলা যায় বিভিন্ন বর্ণের আলোর চ্যুতি [deviation] বিভিন্ন । বেগুনি বর্ণের আলোর চ্যুতি সবচেয়ে বেশি এবং লাল বর্ণের আলোর চ্যুতি সবচেয়ে কম । হলুদ বর্ণের আলোর চ্যুতি বেগুনি এবং লাল বর্ণের আলোর চ্যুতির মাঝামাঝি । তাই হলুদ বর্ণকে মধ্যবর্ণ বলে ।
প্রশ্ন:- সিনেমার পর্দায় যখন ছবি দেখানো হয় তখন সিনেমার ফিল্মকে লেন্স থেকে কত দুরে রাখা হয় ?
উত্তর:- সিনেমার পর্দায় যখন ছবি দেখানো হয় তখন সিনেমার ফিল্মকে লেন্সের ফোকাস দুরত্বের বাইরে রাখা হয় ।
প্রশ্ন:- আতস কাচ কী ?
উত্তর:- কোনো উত্তল লেন্সকে সূর্যরশ্মি বরাবর ধরে যদি লেন্সটির ফোকাস তলে কোনো কাগজ খন্ড বা সহজ দাহ্য কোনো বস্তুকে রাখা হয়, তবে দেখা যায় যে, কিছু সময় পরে কাগজ খন্ড বা ওই বস্তুটিতে আগুন ধরে গিয়েছে । এভাবে ব্যবহৃত উত্তল লেন্সকে আতস কাচ বলে ।
প্রশ্ন:- পরিপূরক বর্ণ কাকে বলে ?
উত্তর:- যে দুটি বর্ণের মিশ্রণে সাদা বর্ণ সৃষ্টি হয়, তাদের পরস্পরের পরিপূরক বর্ণ বলে । যেমন হলুদ ও নীল পরস্পরের পরিপূরক বর্ণ ।
লেন্স দুই প্রকারের আছে ; যথা: [১] উত্তল লেন্স বা অভিসারী লেন্স এবং [২] অবতল লেন্স বা অপসারি লেন্স ।
[১] উত্তল লেন্স [Convex lens] বা অভিসারী লেন্স [Converging lens]:- যে লেন্সের মধ্যস্থল মোটা এবং প্রান্তের দিকটা অপেক্ষাকৃত সরু তাকে উত্তল বা অভিসারী লেন্স বলে ।
[২] অবতল লেন্স [Concave lens] বা অপসারি লেন্স [Diverging lens] :- যে লেন্সের মধ্যস্থল সরু এবং প্রান্তের দিকটা মোটা তাকে অবতল বা অপসারি লেন্স বলে ।
► বিভিন্ন প্রকারের লেন্স [Different Types of Lenses]:- লেন্সের দুই তলের আকারের ওপর নির্ভর করে উত্তল এবং অবতল লেন্সের প্রত্যেককে আবার তিনটি শ্রেণিতে (মোট ছয়টি) ভাগ করা যায় ।
[1] উভোত্তল [Double Convex]:- যে লেন্সের দুটি তলই উত্তল তাকে উভোত্তল লেন্স বলে । এই লেন্সের দুই পৃষ্ঠের বক্রতা ব্যাসার্ধ সমান হলে তাকে সমোত্তল লেন্স [Equiconvex lens] বলে ।
[2] সমতলোত্তল [Plano Convex]:- যে লেন্সের একটি তল সমতল এবং অপর তলটি উত্তল তাকে সমতলোত্তল লেন্স বলে ।
[3] অবতলোত্তল [Concavo Convex]:- যে লেন্সের একটি তল অবতল এবং অপর তলটি উত্তল তাকে অবতলোত্তল লেন্স বলে । এই লেন্সের অবতল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ উত্তল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধের চেয়ে বেশি হয় ।
[4] উভাবতল [Double Concave]:- যে লেন্সের দুটি তলই অবতল হয় তাকে উভাবতল লেন্স বলে । এই লেন্সের দুই পৃষ্ঠের বক্রতা ব্যাসার্ধ সমান হলে তাকে সমাবতল লেন্স [Equiconcave lens] বলে ।
[5] সমতলাবতল [Plano Concave]:- যে লেন্সের একটি তল সমতল এবং অপর তলটি অবতল হয় তাকে সমতলাবতল লেন্স বলে ।
[6] উত্তলাবতল [Convexo Concave]:- যে লেন্সের একটি তল উত্তল এবং অপর তলটি অবতল তাকে উত্তলাবতল লেন্স বলে । এই লেন্সের উত্তল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধের চেয়ে অবতল তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ কম হয় ।
► লেন্স কর্তৃক আলোর প্রতিসরণ এবং ফোকাসিং ক্রিয়া [Refraction of light by lens and focusing action]:-
একটি উত্তল কিংবা অবতল লেন্সকে কয়েকটি ছোটো ছোটো খন্ডিত প্রিজমের সমষ্টি বলে মনে করা যেতে পারে । উত্তল লেন্সের ক্ষেত্রে এই প্রিজমগুলির ভূমি লেন্সের কেন্দ্রের দিকে অভিমুখী এবং লেন্সের কেন্দ্র থেকে যে প্রিজমটি যত দূরবর্তী তার প্রতিসারক কোণ তত বেশি । আবার আলোকরশ্মি কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে গেলে ভূমির দিকে বেঁকে যায় এবং যে প্রিজমের প্রতিসারক কোণ যত বেশি তার ক্ষেত্রে আপতিত রশ্মির চ্যুতিও তত বেশি । তাই উত্তল লেন্সের ভিতর দিয়ে প্রতিসৃত হলে সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ অভিসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত হয় এবং একটি বিন্দুতে মিলিত হয় ।একেই লেন্সের ফোকাসিং ক্রিয়া বলে । এজন্য উত্তল লেন্সকে অভিসারী লেন্স বলা হয় ।
এইভাবে অবতল লেন্সে প্রিজমগুলির ভূমি লেন্সের কেন্দ্র থেকে বিপরীত দিকে থাকে । এক্ষেত্রে রাশ্মিগুলির চ্যুতি বিপরীত হবে । ফলে সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ লেন্স কর্তৃক প্রতিসৃত হওয়ার পর মনে হবে যেন একটি বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে অর্থাৎ, সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ অপসারী রশ্মিগুচ্ছে পরিণত হবে । এজন্য অবতল লেন্সকে অপসারী লেন্স বলা হয় ।
• দ্রষ্টব্য : লেন্সের চারপাশের মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক লেন্সের উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক অপেক্ষা বেশি হলে, উত্তল ও অবতল লেন্সের ওপরে বর্ণিত ক্রিয়া উল্টে যাবে— অর্থাৎ উত্তল লেন্স অপসারী এবং অবতল লেন্স অভিসারী হবে । সুতরাং উত্তল লেন্স মাত্রই অভিসারী আর অবতল লেন্স মাত্রই অপসারী হবে— একথা ঠিক নয় । লেন্সের অপসারী ও অভিসারী হওয়ার ক্ষমতা লেন্সের পারিপার্শ্বিক মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে ।
► কয়েকটি সংজ্ঞা [Some Definitions]:-
[i] বক্রতা কেন্দ্র [Centre of curvature]:- লেন্সের উভয় তলই যদি গোলীয় হয় তবে এরা প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট গোলকের অংশ হবে ।ওই গোলকের কেন্দ্রকে ওই তলের বক্রতা কেন্দ্র বলে ।
[ii] বক্রতা ব্যাসার্ধ [Radius of of curvature]:- লেন্সের কোনো তল যে গোলকের অংশ হবে ওই গোলকের ব্যাসার্ধকে ওই তলের বক্রতা ব্যাসার্ধ বলে ।
[iii] প্রধান অক্ষ [Principal axis]:- যদি লেন্সের দুই তল গোলীয় হয় তবে ওই তলদুটির বক্রতা কেন্দ্র দুটিকে যোগ করলে যে সরলরেখা পাওয়া যায় তাকে ওই লেন্সের প্রধান অক্ষ বলে ।
[iv] পাতলা লেন্স [Thin lens]:- লেন্সের বেধ যদি ওর পৃষ্ঠতল দুটির বক্রতা ব্যাসার্ধের তুলনায় খুব ছোটো হয়, তাহলে ওই লেন্সকে পাতলা লেন্স বলে ।
[v] উন্মেষ [Aperture]:- লেন্সের ব্যাসকে লেন্সটির উন্মেষ বলে ।
[vi] আলোককেন্দ্র [Optical Centre]:- যদি কোনো আলোক-রশ্মি লেন্সের কোনো তলে এরূপভাবে আপতিত হয় যে, লেন্সের ভিতর দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে দ্বিতীয় তল থেকে নির্গত হওয়ায় সময় এটি আপতিত রশ্মির সমান্তরালভাবে নির্গত হয়, তবে লেন্সের ভিতরে প্রতিসৃত রশ্মির গতিপথ প্রধান অক্ষকে যে বিন্দুতে ছেদ করে সেই বিন্দুকে লেন্সের আলোককেন্দ্র বলে । পাতলা লেন্সের ক্ষেত্রে আলোককেন্দ্র দিয়ে কোনো আলোক-রশ্মি গেলে, রশ্মির কোনো চ্যুতি বা পার্শ্ব-সরণ হয় না— আপতিত রশ্মি সোজাপাথে লেন্স থেকে নির্গত হয়ে যায় ।
◘ প্রমাণ করা যায় যে— অবতলোত্তল এবং উত্তলাবতল লেন্সে আলোককেন্দ্র অপেক্ষাকৃত কম বক্রতা ব্যাসার্ধের তলের দিকে লেন্সের বাইরে প্রধান অক্ষের উপর অবস্থান করে ।
[vii] মুখ্য ফোকাস ও ফোকাস দুরত্ব [Principal focus and focal length]:- যদি কোনো সমান্তরাল রশ্মিগুচ্ছ লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরালভাবে এসে লেন্সের ওপর পড়ে, তাহলে প্রতিসরণের পর রশ্মিগুচ্ছ উত্তল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর অবস্থিত একটি বিন্দুতে মিলিত হয়; কিংবা অবতল লেন্সের ক্ষেত্রে প্রধান অক্ষের ওপর অবস্থিত কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় । সেই বিন্দুটিকে লেন্সের মুখ্য ফোকাস বলে । লেন্সের আলোককেন্দ্র থেকে মুখ্য ফোকাসের দূরত্বকে ফোকাস(ƒ) দূরত্ব বলা হয় ।
◘ লেন্সের দুটি মুখ্য ফোকাস আছে । ওই দুটি ফোকাস আলোক কেন্দ্রের বিপরীত দিকে এবং লেন্সের উভয় দিকের মাধ্যম একই রকম হলে, আলোক কেন্দ্র থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় ফোকাস সমান দূরত্বে থাকে ।
[viii] ফোকাস তল [Focal plane]:- মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থিত তলকে লেন্সের ফোকাস তল বলে ।
[ix] গৌণ ফোকাস [Secondary focus]:- যদি একগুচ্ছ সমান্তরাল রশ্মি লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে সামান্য কোণ করে লেন্সে আপতিত হয়, তাহলে প্রতিসরণের পর রশ্মিগুচ্ছ উত্তল লেন্সের ফোকাস তলে মিলিত হয়, কিংবা অবতল লেন্সের ফোকাস তলের কোনো বিন্দু থেকে অপসৃত হচ্ছে বলে মনে হয় । এই বিন্দুকে লেন্সের গৌণ ফোকাস বলে ।
► উত্তল লেন্স দ্বারা সৃষ্ট সদ্ ও অসদ প্রতিবিম্ব গঠন [Formation of real and virtual images by a convex lens]:-
উত্তল লেন্সের সাহায্যে বস্তুর যে প্রতিবিম্ব গঠিত হয়, তা লেন্সের চারটি ধর্মের ওপর নির্ভর করে ।
(i) যে আলোক-রশ্মি লেন্সের আলোক কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে যায়, প্রতিসরণের পর তার অভিমুখের কোনো পরিবর্তন হয় না ।
(ii) বস্তু থেকে নির্গত আলোক-রশ্মি, প্রধান অক্ষের সমান্তরাল হয়ে উত্তল লেন্সে আপতিত হলে প্রতিসরণের পর মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে যাবে ।
(iii) উত্তল লেন্সের মুখ্য ফোকাসের মধ্য দিয়ে আগত কোনো আলোক-রশ্মি লেন্সে প্রতিসৃত হলে প্রধান অক্ষের সমান্তরাল হয়ে নির্গত হবে ।
(iv) কোনো বস্তু লেন্সের প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে অবস্থান করলে ওর প্রতিবিম্বটিও প্রধান অক্ষের সঙ্গে লম্বভাবে গঠিত হবে ।
(i) বস্তুর চেয়ে খুব ক্ষুদ্র সদবিম্ব :
(ii) বস্তুর চেয়ে বড়ো সদবিম্ব :
(iii) বস্তুর চেয়ে বড়ো অসদবিম্ব :
► রৈখিক বিবর্ধন [Linear magnification]:- লেন্স দ্বারা লক্ষবস্তুর যে প্রতিবিম্ব গঠিত হয় তা লক্ষবস্তুর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে বস্তু অপেক্ষা বড়ো বা ছোটো বা সমান হতে পারে অর্থাৎ লেন্সের বিবর্তন ক্ষমতা [magnifying power] আছে । রৈখিক বিবর্ধন বলতে প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য ও লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্যের অনুপাত বুঝায় ।
রৈখিক বিবর্ধন (m) = প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য / লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্য
প্রমাণ করা যায় যে লেন্সের আলোককেন্দ্র থেকে বস্তু দূরত্ব = u এবং প্রতিবিম্ব দূরত্ব = v হলে, যে-কোনো লেন্সের ক্ষেত্রে রৈখিক বিবর্ধন m = প্রতিবিম্বের দৈর্ঘ্য / লক্ষবস্তুর দৈর্ঘ্য =v/u ।
► বিবর্ধক কাচরূপে উত্তল লেন্স [Convex lens as a magnifying glass]:-
লক্ষবস্তু যদি উত্তল লেন্সের ফোকাস দূরত্বের মধ্যে থাকে, তাহলে লেন্স দ্বারা গঠিত প্রতিবিম্ব অসদ, এবং বস্তুর চেয়ে আকারে বড়ো এবং সোজা হয় । উত্তল লেন্সকে বিবর্ধক কাচ হিসাবে ব্যবহার করা হয় । কোনো বই -এর পাতার খুব কাছে উত্তল লেন্স ধরে ওপর থেকে দেখলে অক্ষরগুলিকে বড়ো বড়ো দেখায় । লেন্সের ফোকাস দৈর্ঘ্য যত কম হয়, প্রতিবিম্বের বিবর্ধনও তত বেশি হয় । তাই খুব কম ফোকাস দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট উত্তল লেন্সকে বিবর্ধক কাচ হিসাবে ব্যবহার করা হয় ।
• লেন্স চিনবার সহজ উপায় :- লেন্সের খুব কাছে একটি আঙ্গুল রেখে অপর পাশ থেকে দেখলে যদি আঙ্গুলটির প্রতিবিম্ব আকারে বড়ো এবং সোজা হয় তবে লেন্সটি হবে উত্তল, আর যদি প্রতিবিম্ব আকারে ছোটো এবং সোজা হয় তবে লেন্সটি হবে অবতল ।
► আলোর বিচ্ছুরণ [Dispersion of light]:-
• সংজ্ঞা:- সাদা কিংবা কোনো বহুবর্ণী রশ্মিগুচ্ছের বিভিন্ন বর্ণে বিভাজিত হওয়ার ঘটনাকে আলোর বিচ্ছুরণ বলে । স্যার আইজ্যাক নিউটন আলোর বিচ্ছুরণ আবিষ্কার করেন । তিনি দেখতে পান যে, সূর্য রশ্মি (সাদা আলো) কাচের প্রিজমের ভিতর দিয়ে গেলে সাতটি বিভিন্ন বর্ণের রশ্মিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে ।
[i] প্রিজম:- তিনটি আয়তাকার এবং দুটি ত্রিভুজাকার তল দ্বারা সীমাবদ্ধ সমসত্ব ও স্বচ্ছ প্রতিসারক মাধ্যমকে প্রিজম বলে ।
[ii] প্রতিসারক তল:- আলোক রশ্মি প্রিজমের যে তলে আপতিত হয় এবং তল থেকে নির্গত হয় তাদের প্রতিসারক তল বলে ।
[iii] প্রান্তরেখা:- পাশাপাশি দুটি প্রতিসারক তল পরস্পর যে রেখায় মিলিত হয়, তাকে প্রান্তরেখা বলে ।
[iv] প্রধান ছেদ:- প্রিজমের প্রতিসারক তলকে লম্বভাবে ছেদ করলে যে তল পাওয়া যায়, তাকে প্রিজমের প্রধান ছেদ বলে ।
[v] প্রতিসারক কোণ :- দুটি প্রতিসারক তল পরস্পর যে কোণে মিলিত হয়, ওই কোণকে প্রতিসারক কোণ বলে ।
[vi] ভূমি:- প্রতিসারক কোণের বিপরীত তলকে প্রিজমের ভূমি বলে ।
► সাদা আলোর বিচ্ছুরণ [Dispersion of white light]:-
• পরীক্ষা:- একটি অস্বচ্ছ পর্দার একটি সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে সাদা আলোক রশ্মি একটি প্রিজমের প্রতিসারক তল এর ওপর আপতিত হল । প্রিজমের অপর প্রতিসারক তল থেকে নির্গত হয়ে আলোক রশ্মি যখন একটি পর্দা -এর উপর পড়বে তখন পর্দায় সাতটি বিভিন্ন বর্ণবিশিষ্ট একটি পটি দেখতে পাওয়া যাবে । এই পটির একেবারে ওপরে লাল [Red], তারপর যথাক্রমে কমলা [Orange], হলুদ [Yellow], সবুজ [Green], আকাশি নীল [Blue], গাঢ় নীল [Indigo] এবং সবচেয়ে নীচে বেগুনি [Violet] থাকে । এই বহুবর্ণবিশিষ্ট পটিকে বর্ণালী বলে । প্রিজম আলোর বর্ণ সৃষ্টি করে না— সাদা বা বহুবর্ণী আলোর মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন বর্ণের আলোক রশ্মিগুলিকে পৃথক করে মাত্র ।
♦ শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না কেন ?
শূন্য মাধ্যমে সব বর্ণের আলো সমান বেগে চলার ফলে আলোকরশ্মির কোনো প্রকার চ্যুতি ঘটে না । তাই শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না ।
• রামধনু [Rainbow]:- রামধনু হল আলোক বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ । যদি বায়ুমণ্ডল সদ্য বৃষ্টিস্নাত হয়, তবে কখনো কখনো সূর্যের বিপরীত দিকের আকাশে ধনুকের মতো বাঁকা বিভিন্ন রং -এর পটি দেখা যায়— একেই রামধনু বলে । বৃষ্টির কণা দ্বারা সুর্যরশ্মির বিচ্ছুরণের ফলে এই ঘটনা ঘটে ।
☼ বর্ণালি [Spectrum]:-
• সংজ্ঞা:- সাদা আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রতিসরণের ফলে বিশ্লিষ্ট হয়ে সাতটি বিভিন্ন বর্ণের আলোকগুচ্ছে পরিণত হয় । প্রিজম থেকে নির্গত এই আলোকগুচ্ছকে পর্দায় ফেললে, পর্দায় ওই সাতটি বিভিন্ন বর্ণের আলোক দ্বারা তৈরি চওড়া যে পটি পাওয়া যায়, তাকে বর্ণালি বলে ।
সাদা আলোর বিচ্ছুরণে প্রাপ্ত বর্ণালির মধ্যে যে সাতটি বর্ণ থাকে, সেই বর্ণগুলির ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষরগুলিকে, বর্ণালিতে পাওয়া সাতটি বর্ণের ক্রম অনুযায়ী সাজালে 'VIBGYOR' শব্দটি পাওয়া যায় । অনুরূপ ভাবে বাংলা নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে সাজালে (বেগুনি, নীল, আকাশি নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, এবং লাল) 'বেনীআসহকলা' শব্দটি পাওয়া যায় ।
☼ শুদ্ধ বর্ণালি [Pure Spectrum]:- যে বর্ণালিতে সাদা আলোর সাতটি বর্ণ পৃথক ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় এবং বর্ণগুলি নিজ নিজ স্থান দখল করে থাকে, তাকে শুদ্ধ বর্ণালি বলে ।
☼ অশুদ্ধ বর্ণালি [Impure Spectrum]:- যে বর্ণালিতে সাদা আলোর সাতটি বর্ণ একে অন্যের ওপর পড়ার ফলে বিভিন্ন বর্ণ পৃথক ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না এবং বর্ণগুলি নিজ নিজ স্থান দখল করে থাকে না, তাকে অশুদ্ধ বর্ণালি বলে ।
প্রশ্ন:- সাদা আলোর বিশুদ্ধ বর্ণালির প্রান্তিক বর্ণ দুটি কী কী ?
উত্তর:- সাদা আলোর বিশুদ্ধ বর্ণালির প্রান্তিক বর্ণ দুটি হল লাল ও বেগুনি ।
প্রশ্ন:- শূন্য মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না কেন ?
উত্তর:- শূন্য মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সমতুল কোনো কণা না থাকায় ওই মাধ্যমে আলোর বিচ্ছুরণ হয় না ।
প্রশ্ন:- আলোকের বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ দাও ।
উত্তর:- আলোকের বিচ্ছুরণের একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ হল রামধনু ।
প্রশ্ন:- বস্তুর কোন অবস্থানে উত্তল লেন্স দ্বারা সদ্ প্রতিবিম্ব গঠিত হয় ?
উত্তর:- উত্তল লেন্স থেকে কোনো বস্তুর দুরত্ব লেন্সটির ফোকাস দৈর্ঘ্যের সমান বা ফোকাস দৈর্ঘ্য থেকে বেশি হলে বস্তুটির সদ্ প্রতিবিম্ব গঠিত হয় ।
প্রশ্ন:- বিবর্ধক কাচে কী ধরনের লেন্স ব্যবহার করা হয় ?
উত্তর:- বিবর্ধক কাচে উত্তল লেন্স ব্যবহার করা হয় ।
প্রশ্ন:- বিবর্ধক কাচের দুটি ব্যবহার উল্লেখ করো ।
উত্তর:- বইয়ের ছোটো অক্ষর এবং ঘড়ির সূক্ষ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দেখার জন্য বিবর্ধক কাচ ব্যবহার করা হয় ।
প্রশ্ন:- কোন বর্ণকে মধ্য বর্ণ বলে ?
উত্তর:- বর্ণালি থেকে বলা যায় বিভিন্ন বর্ণের আলোর চ্যুতি [deviation] বিভিন্ন । বেগুনি বর্ণের আলোর চ্যুতি সবচেয়ে বেশি এবং লাল বর্ণের আলোর চ্যুতি সবচেয়ে কম । হলুদ বর্ণের আলোর চ্যুতি বেগুনি এবং লাল বর্ণের আলোর চ্যুতির মাঝামাঝি । তাই হলুদ বর্ণকে মধ্যবর্ণ বলে ।
প্রশ্ন:- সিনেমার পর্দায় যখন ছবি দেখানো হয় তখন সিনেমার ফিল্মকে লেন্স থেকে কত দুরে রাখা হয় ?
উত্তর:- সিনেমার পর্দায় যখন ছবি দেখানো হয় তখন সিনেমার ফিল্মকে লেন্সের ফোকাস দুরত্বের বাইরে রাখা হয় ।
প্রশ্ন:- আতস কাচ কী ?
উত্তর:- কোনো উত্তল লেন্সকে সূর্যরশ্মি বরাবর ধরে যদি লেন্সটির ফোকাস তলে কোনো কাগজ খন্ড বা সহজ দাহ্য কোনো বস্তুকে রাখা হয়, তবে দেখা যায় যে, কিছু সময় পরে কাগজ খন্ড বা ওই বস্তুটিতে আগুন ধরে গিয়েছে । এভাবে ব্যবহৃত উত্তল লেন্সকে আতস কাচ বলে ।
প্রশ্ন:- পরিপূরক বর্ণ কাকে বলে ?
উত্তর:- যে দুটি বর্ণের মিশ্রণে সাদা বর্ণ সৃষ্টি হয়, তাদের পরস্পরের পরিপূরক বর্ণ বলে । যেমন হলুদ ও নীল পরস্পরের পরিপূরক বর্ণ ।
No comments:
Post a Comment